Pages

Friday, June 24, 2011

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণায় তাঁর সমর্থক ও সমালোচক—কেউই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। আগামী এক বছরে মোট ৩৩ হাজার সেনা প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা মার্কিন সেনাধ্যক্ষরা খুব উৎসাহের সঙ্গে অনুমোদন করেননি বলেই গণমাধ্যমের খবর। তাঁরা আরও কম সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে দেশের উদারনৈতিক রাজনীতিবিদেরা এই সেনা প্রত্যাহারকে মনে করছেন, আকারে অত্যন্ত ছোট। বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রেসিডেন্টের সমালোচক রক্ষণশীলরাও মনে করেন যে আফগানিস্তান যুদ্ধ অবসানে যতটা দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হওয়া দরকার, প্রেসিডেন্ট ওবামা তা করছেন না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এই ৩৩ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। মনে রাখা দরকার যে ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময় সেখানে মোট ৩৪ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল এবং এখন সেখানে সর্বমোট প্রায় ৯৭ হাজার সেনা রয়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে যত সেনা আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক ফেরত আনার ঘোষণা দিলেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামার এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিনদের সরে আসার প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। তদুপরি ওবামার বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধান সামরিক নয়, রাজনৈতিক। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং কমবেশি আমরা সবাই জানি। এ কথাও নতুন নয় যে বিদেশি সেনাদের উপস্থিতি আফগানিস্তানে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল নয়। আফগানিস্তানবিষয়ক আলোচনায় পাঁচ-সাত বছর ধরে এ কথাগুলো বলা হলেও রাজনৈতিক সমাধান কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব, সে বিষয়ে বিশদ ও অনুপুঙ্খ আলোচনায় বিশ্লেষকেরা খুব বেশি অগ্রসর হন না। কেননা, পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সমাধানের তাগিদ দেওয়া যতটা সহজ, সমাধানের পথ বর্ণনা করা ততটাই কঠিন। ওবামার বক্তৃতার পর এ আলোচনা জোরদার হবে বলে আশা করা যায়।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের তিনটি দিক রয়েছে—অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। অনেক ক্ষেত্রেই এই তিনটি দিক এত বেশি পরস্পরবিরোধী যে একটি ক্ষেত্রে সহজ সমাধান অন্য দিকগুলোকে অসম্ভব করে তুলবে। অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সমাধানের প্রধান ভিত্তি হতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতার বণ্টন। দেশটির ভৌগোলিক ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভক্তির কথা বাদ দিলেও যে প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে তা হলো, ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ‘তালেবান’ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা। এক দশক ধরে তালেবান আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানের সমাজে তালেবানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। তার আকার না জানা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে কোনো সমাধান যে সম্ভব নয়, এটা উপলব্ধি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তালেবান কোনো একটি একক নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী নয়। তালেবান বলে গণমাধ্যমে যাদের বর্ণনা করা হয়, তাদের তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে: পাকিস্তানের কোয়েটাভিত্তিক গোষ্ঠী, যা ‘কোয়েটা শুরা’ বলে পরিচিত, জালালউদ্দিন ও সিরাজউদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ এবং গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব-ই-ইসলামি। এদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মতভেদ রয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যে কোনো ধরনের সমঝোতার অর্থ তালেবানের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়া, তাদের কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। তালেবানের স্বল্প সময়ের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ও গত এক দশকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নারীদের অধিকার, মানবাধিকার, শরিয়ার ব্যাখ্যা, পোশাক, শিক্ষা, আচরণ ইত্যাদি কিছু বিষয়ে তালেবানকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথগুলো অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া। যদিও তালেবানের কোনো কোনো অংশ দাবি করছে যে গত ১০ বছরে তারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা আর এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার পক্ষে নয়। কিন্তু তার নিশ্চয়তা বিধান না করা গেলেও কি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন? অন্যদিকে তাদের বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধানই যে অভ্যন্তরীণভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা বলা বাহুল্য।
আফগানিস্তানে যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমাধানের সময় মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে তার ‘পেছনের উঠোন’ বলে মনে করে। পাকিস্তানের এই নীতি নতুন নয় এবং সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন ও পরে সরাসরি তালেবান সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বহাল রাখা। এক দশক ধরে পাকিস্তান যে একাধারে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটারও কারণ একই। পাকিস্তানের ধারণা এবং যার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ রয়েছে যে আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ওপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে, আফগানিস্তানে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা হতে না দেওয়া, যা পাকিস্তানের ‘পুতুল সরকার’-এ পরিণত হয়। ভারত সংগত কারণেই মনে করে যে তালেবানের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ হলো ভারতবিরোধী আফগানিস্তান তৈরি করা। গত এক দশকে আফগানিস্তানে ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগ এত বেশি যে তার জন্য এখন কোনো রকম নিশ্চয়তা ছাড়া পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশী ইরান যদিও চায় না যে তালেবান শক্তিশালী হোক, কিন্তু ইরানি নেতারা চান যে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরাজিত’ হোক। ইরানের জন্য স্থিতিশীল আফগানিস্তান বেশি প্রয়োজন। তারা পাকিস্তান ও ভারত—যেকোনো দেশের প্রভাবই মানতে রাজি, তবে তুলনামূলকভাবে ভারতের প্রভাবই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কারজাই (বা এ-জাতীয় অন্য কোনো) সরকার সমর্থন করা। ফলে ইরানের আফগানিস্তান-নীতি খানিকটা অস্পষ্ট।
সহজ করে বললে, এই অঞ্চলের তিনটি প্রধান শক্তি—পাকিস্তান, ভারত ও ইরান চায় আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান যেন কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘমেয়াদি তাদের স্বার্থের প্রতিকূল না যায়।
আন্তর্জাতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ আফগানিস্তানকে বিবেচনা করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে। তালেবান ও আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠতা থেকেই গোটা পরিস্থিতির উদ্ভব—এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওবামা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
যদিও ২০০১ সালের তুলনায় আল-কায়েদা এখন দুর্বল ও অসংগঠিত, বিশেষত আফগানিস্তানে আল-কায়েদার উপস্থিতি সীমিত। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানকেন্দ্রিক আল-কায়েদার সমর্থকেরা আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তালেবান ও অন্য যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে এ নিশ্চয়তাই আশা করে। তালেবানের একাংশ আল-কায়েদার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে চায় না বলে যেসব তথ্য জানা যায়, তার ওপর নির্ভর করা কতটা বাস্তবোচিত? যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চায় তালেবান স্পষ্ট করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করুক, তাদের নিন্দা করুক এবং ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্ক না গড়ার নিশ্চয়তা দিক। এযাবৎ তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, অন্ততপক্ষে প্রকাশ্যে তার কোনো লক্ষণ তালেবান দেখায়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তার শিগগিরই সমাধান হবে না। পাশাপাশি পাকিস্তানের ভেতর পাকিস্তানি তালেবান সমর্থকদের যে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য তা হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ করবে না, যা পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশের ভবিষ্যৎকেই সংকটাপন্ন করে তোলে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যে যুক্ত, সেটা প্রেসিডেন্ট ওবামা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আফগানিস্তান পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পথে এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মুখেই প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন সেনা হ্রাসের পাশাপাশি শিগগিরই অন্যান্য দেশ, বিশেষত ব্রিটেন তাদের সেনাসংখ্যা কমাবে বলেই ধারণা করা যায়। তদুপরি ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বিদেশি সেনাদের সরিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ন্যাটো। এই মুহূর্তে সেনা হ্রাসের সংখ্যা ছোট হলেও তা এ প্রক্রিয়ার সূচনা করছে। কিন্তু আগামী আড়াই বছরের মধ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, স্থিতিশীল কোনো রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
আলী রীয়াজ:

ওবামার সিদ্ধান্তে কোনো পক্ষই খুশি নয়

Posted by Unknown  |  No comments

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণায় তাঁর সমর্থক ও সমালোচক—কেউই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। আগামী এক বছরে মোট ৩৩ হাজার সেনা প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা মার্কিন সেনাধ্যক্ষরা খুব উৎসাহের সঙ্গে অনুমোদন করেননি বলেই গণমাধ্যমের খবর। তাঁরা আরও কম সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে দেশের উদারনৈতিক রাজনীতিবিদেরা এই সেনা প্রত্যাহারকে মনে করছেন, আকারে অত্যন্ত ছোট। বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রেসিডেন্টের সমালোচক রক্ষণশীলরাও মনে করেন যে আফগানিস্তান যুদ্ধ অবসানে যতটা দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হওয়া দরকার, প্রেসিডেন্ট ওবামা তা করছেন না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এই ৩৩ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। মনে রাখা দরকার যে ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময় সেখানে মোট ৩৪ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল এবং এখন সেখানে সর্বমোট প্রায় ৯৭ হাজার সেনা রয়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে যত সেনা আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক ফেরত আনার ঘোষণা দিলেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামার এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিনদের সরে আসার প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। তদুপরি ওবামার বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধান সামরিক নয়, রাজনৈতিক। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং কমবেশি আমরা সবাই জানি। এ কথাও নতুন নয় যে বিদেশি সেনাদের উপস্থিতি আফগানিস্তানে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল নয়। আফগানিস্তানবিষয়ক আলোচনায় পাঁচ-সাত বছর ধরে এ কথাগুলো বলা হলেও রাজনৈতিক সমাধান কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব, সে বিষয়ে বিশদ ও অনুপুঙ্খ আলোচনায় বিশ্লেষকেরা খুব বেশি অগ্রসর হন না। কেননা, পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সমাধানের তাগিদ দেওয়া যতটা সহজ, সমাধানের পথ বর্ণনা করা ততটাই কঠিন। ওবামার বক্তৃতার পর এ আলোচনা জোরদার হবে বলে আশা করা যায়।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের তিনটি দিক রয়েছে—অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। অনেক ক্ষেত্রেই এই তিনটি দিক এত বেশি পরস্পরবিরোধী যে একটি ক্ষেত্রে সহজ সমাধান অন্য দিকগুলোকে অসম্ভব করে তুলবে। অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সমাধানের প্রধান ভিত্তি হতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতার বণ্টন। দেশটির ভৌগোলিক ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভক্তির কথা বাদ দিলেও যে প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে তা হলো, ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ‘তালেবান’ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা। এক দশক ধরে তালেবান আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানের সমাজে তালেবানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। তার আকার না জানা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে কোনো সমাধান যে সম্ভব নয়, এটা উপলব্ধি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তালেবান কোনো একটি একক নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী নয়। তালেবান বলে গণমাধ্যমে যাদের বর্ণনা করা হয়, তাদের তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে: পাকিস্তানের কোয়েটাভিত্তিক গোষ্ঠী, যা ‘কোয়েটা শুরা’ বলে পরিচিত, জালালউদ্দিন ও সিরাজউদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ এবং গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব-ই-ইসলামি। এদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মতভেদ রয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যে কোনো ধরনের সমঝোতার অর্থ তালেবানের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়া, তাদের কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। তালেবানের স্বল্প সময়ের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ও গত এক দশকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নারীদের অধিকার, মানবাধিকার, শরিয়ার ব্যাখ্যা, পোশাক, শিক্ষা, আচরণ ইত্যাদি কিছু বিষয়ে তালেবানকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথগুলো অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া। যদিও তালেবানের কোনো কোনো অংশ দাবি করছে যে গত ১০ বছরে তারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা আর এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার পক্ষে নয়। কিন্তু তার নিশ্চয়তা বিধান না করা গেলেও কি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন? অন্যদিকে তাদের বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধানই যে অভ্যন্তরীণভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা বলা বাহুল্য।
আফগানিস্তানে যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমাধানের সময় মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে তার ‘পেছনের উঠোন’ বলে মনে করে। পাকিস্তানের এই নীতি নতুন নয় এবং সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন ও পরে সরাসরি তালেবান সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বহাল রাখা। এক দশক ধরে পাকিস্তান যে একাধারে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটারও কারণ একই। পাকিস্তানের ধারণা এবং যার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ রয়েছে যে আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ওপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে, আফগানিস্তানে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা হতে না দেওয়া, যা পাকিস্তানের ‘পুতুল সরকার’-এ পরিণত হয়। ভারত সংগত কারণেই মনে করে যে তালেবানের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ হলো ভারতবিরোধী আফগানিস্তান তৈরি করা। গত এক দশকে আফগানিস্তানে ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগ এত বেশি যে তার জন্য এখন কোনো রকম নিশ্চয়তা ছাড়া পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশী ইরান যদিও চায় না যে তালেবান শক্তিশালী হোক, কিন্তু ইরানি নেতারা চান যে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরাজিত’ হোক। ইরানের জন্য স্থিতিশীল আফগানিস্তান বেশি প্রয়োজন। তারা পাকিস্তান ও ভারত—যেকোনো দেশের প্রভাবই মানতে রাজি, তবে তুলনামূলকভাবে ভারতের প্রভাবই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কারজাই (বা এ-জাতীয় অন্য কোনো) সরকার সমর্থন করা। ফলে ইরানের আফগানিস্তান-নীতি খানিকটা অস্পষ্ট।
সহজ করে বললে, এই অঞ্চলের তিনটি প্রধান শক্তি—পাকিস্তান, ভারত ও ইরান চায় আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান যেন কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘমেয়াদি তাদের স্বার্থের প্রতিকূল না যায়।
আন্তর্জাতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ আফগানিস্তানকে বিবেচনা করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে। তালেবান ও আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠতা থেকেই গোটা পরিস্থিতির উদ্ভব—এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওবামা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
যদিও ২০০১ সালের তুলনায় আল-কায়েদা এখন দুর্বল ও অসংগঠিত, বিশেষত আফগানিস্তানে আল-কায়েদার উপস্থিতি সীমিত। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানকেন্দ্রিক আল-কায়েদার সমর্থকেরা আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তালেবান ও অন্য যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে এ নিশ্চয়তাই আশা করে। তালেবানের একাংশ আল-কায়েদার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে চায় না বলে যেসব তথ্য জানা যায়, তার ওপর নির্ভর করা কতটা বাস্তবোচিত? যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চায় তালেবান স্পষ্ট করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করুক, তাদের নিন্দা করুক এবং ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্ক না গড়ার নিশ্চয়তা দিক। এযাবৎ তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, অন্ততপক্ষে প্রকাশ্যে তার কোনো লক্ষণ তালেবান দেখায়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তার শিগগিরই সমাধান হবে না। পাশাপাশি পাকিস্তানের ভেতর পাকিস্তানি তালেবান সমর্থকদের যে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য তা হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ করবে না, যা পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশের ভবিষ্যৎকেই সংকটাপন্ন করে তোলে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যে যুক্ত, সেটা প্রেসিডেন্ট ওবামা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আফগানিস্তান পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পথে এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মুখেই প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন সেনা হ্রাসের পাশাপাশি শিগগিরই অন্যান্য দেশ, বিশেষত ব্রিটেন তাদের সেনাসংখ্যা কমাবে বলেই ধারণা করা যায়। তদুপরি ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বিদেশি সেনাদের সরিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ন্যাটো। এই মুহূর্তে সেনা হ্রাসের সংখ্যা ছোট হলেও তা এ প্রক্রিয়ার সূচনা করছে। কিন্তু আগামী আড়াই বছরের মধ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, স্থিতিশীল কোনো রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

1:48 AM Share:

Tuesday, May 31, 2011

৩২তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কী থাকবে, তা আমি এখনই বলে দিতে পারি। বলে দিতে পারি এ জন্য যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মতোই সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আগামীবার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকবে: এশিয়ায় সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান—(ক) আলাওল (খ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (গ) সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (ঘ) সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশে শিক্ষার মান এত উঁচু এবং তরুণদের সারা দিনরাত মোবাইল ফোনে কথা বলার পরেও পড়াশোনার অভ্যাস এত বেশি যে, শিক্ষার্থীরা ভাগাভাগি করে চারটিতেই টিক মারবেন। খ-তে সবচেয়ে বেশি টিক পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাঁরা করেন, তাঁরা গত ৪০ বছরের কোনো না কোনো সময় উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। কলেজ এখন একটি বাতিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সবাই চাইছে, স্কুলটা কোনো রকমে পার হয়ে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। ৯০ বছর আগে দেশে যত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, আজ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ তত। আরও ৬০টির অনুমতির জন্য আবেদনপত্র পড়েছে। এমন সব মানুষ আবেদন করেছেন বা সুপারিশ করেছেন যে কার সাধ্য তা রোধিবে দিয়ে বালির বাঁধ।
৩১তম বিসিএস প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা হয়ে গেল। একটি প্রশ্ন ছিল: রহিম, করিম ও গাজী তিনজনে একটি কাজ করতে পারে যথাক্রমে ১৫, ৬ ও ১০ দিনে। তারা একত্রে তিনজনে কাজটি কত দিনে শেষ করতে পারবে? উত্তরে চারটি অপশন ছিল—(ক) ২১ দিনে (খ) ১৮ দিনে (গ) ৭ দিনে (ঘ) ১৫ দিনে। আমার মতো গণিত-অজ্ঞ নয়, সত্যি যাঁরা গণিতজ্ঞ, তাঁরা বলছেন, চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে তিন দিন।
পরীক্ষার্থীদের কারও উচিত ছিল, প্রশ্নপত্রের মার্জিনে লিখে দেওয়া: তিনজন একসঙ্গে কাজটি করবে না। কারণ, দেশের নেতারা তিনজন তো দূরের কথা, দুজনও একসঙ্গে কাজ করা পছন্দ করেন না। সুতরাং রহিম, করিম ও গাজী একসঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই পারে না।
আরেকটি প্রশ্ন ছিল: বাংলাদেশ কোন সাল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছে? চারটি অপশন—(ক) ১৯৮২ (খ) ১৯৮৫ (গ) ১৯৭৫ (ঘ) ১৯৮৯। চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে ১৯৮৮ সাল। প্রশ্ন তৈরিকারী বলবেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কবে গেল সেটা বড় কথা নয়, ডলার কত এল সেটাই আসল। প্রশ্নপত্রে, ডলারের কথা নেই কেন?
এর আগে ৩০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও ভুল ও অসংগতি ছিল। এবারের ভুলের ব্যাপারে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভুলের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তবে পরীক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না।’
কর্মকর্তা বিব্রত বা লজ্জিত হননি। সোজা বলে দিয়েছেন, সমস্যা হবে না। এ দেশে কোনো অপরাধ, অপকর্ম ও ভুলেই যেকোনো সমস্যা হয় না, তা কে না জানে। সমস্যা না হলে ভুল করতে দোষ কী? খুব বড় ভুল যদি হয়, তা হলে ভুলকরনেওয়ালা মাথা চাপড়ে বলবেন: জোট সরকারের সময় আমারে যে-বিপদে ফেইলা দিছিল যে বাঁচারই কথা না। তাড়াতাড়ি নির্বাচনটা না দিলে এক্কেবারে গেছিলাম। তা ছাড়া ঊনত্রিশে ডিসেম্বর জীবন বাজি রাইখা—।
পিএসসির পরীক্ষার দায়িত্বরত একজন সদস্য ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করে থাকেন না—এ জন্য এমনটা হতেও পারে। পরীক্ষার্থীদের অযথা উদ্বিগ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করেন না, চেয়ারম্যান করেন না, সচিব করেন না, মন্ত্রী করেন না—তা সবাই জানে। তবে কেউ না কেউ তো করেন। যিনি করেছেন, এখন আর তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
পরীক্ষা গ্রহণেও ছিল নানা রকম অনাচার। পরীক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। ৫৯৬ পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে বিভ্রান্তি। একাধিক পরীক্ষার্থীর একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর। সিট খুঁজতে ও পরীক্ষাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষার্থীদের কিছু সুবিধার ব্যবস্থাও করে দেন পিএসসির কর্মকর্তারা। ‘পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।’ মানা হয়নি কারণ, পরীক্ষা দিচ্ছেন কোন প্রজন্ম ও সংগঠনের সদস্যরা, তা তো বিবেচনা করতে হবে এবং মাথায়-হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ফেরার সাধ এই বীরের দেশেও খুব কম মানুষেরই রয়েছে।
সমাজে ও রাষ্ট্রে সবকিছু চক্রাকারে হয়। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। নৈতিকতা ও শিক্ষার মান উঁচু হলে সুশিক্ষিত মানুষ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাছাই করে সবচেয়ে সেরাদের প্রশাসনে নিয়োগ দিলে ভালো ও দক্ষ প্রশাসন পাওয়া যায়। নিম্নমানের শিক্ষা, কারসাজি করে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে, মেধাবীরা সুযোগ না পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসন ধ্বংস হয়ে যায়। তা যে যায়, তার প্রমাণ গত ৪০ বছরের বাংলাদেশ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সৈয়দ আবুল মকসুদ

ভুল সবই ভুল

Posted by Unknown  |  No comments

৩২তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কী থাকবে, তা আমি এখনই বলে দিতে পারি। বলে দিতে পারি এ জন্য যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মতোই সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আগামীবার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকবে: এশিয়ায় সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান—(ক) আলাওল (খ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (গ) সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (ঘ) সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশে শিক্ষার মান এত উঁচু এবং তরুণদের সারা দিনরাত মোবাইল ফোনে কথা বলার পরেও পড়াশোনার অভ্যাস এত বেশি যে, শিক্ষার্থীরা ভাগাভাগি করে চারটিতেই টিক মারবেন। খ-তে সবচেয়ে বেশি টিক পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাঁরা করেন, তাঁরা গত ৪০ বছরের কোনো না কোনো সময় উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। কলেজ এখন একটি বাতিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সবাই চাইছে, স্কুলটা কোনো রকমে পার হয়ে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। ৯০ বছর আগে দেশে যত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, আজ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ তত। আরও ৬০টির অনুমতির জন্য আবেদনপত্র পড়েছে। এমন সব মানুষ আবেদন করেছেন বা সুপারিশ করেছেন যে কার সাধ্য তা রোধিবে দিয়ে বালির বাঁধ।
৩১তম বিসিএস প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা হয়ে গেল। একটি প্রশ্ন ছিল: রহিম, করিম ও গাজী তিনজনে একটি কাজ করতে পারে যথাক্রমে ১৫, ৬ ও ১০ দিনে। তারা একত্রে তিনজনে কাজটি কত দিনে শেষ করতে পারবে? উত্তরে চারটি অপশন ছিল—(ক) ২১ দিনে (খ) ১৮ দিনে (গ) ৭ দিনে (ঘ) ১৫ দিনে। আমার মতো গণিত-অজ্ঞ নয়, সত্যি যাঁরা গণিতজ্ঞ, তাঁরা বলছেন, চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে তিন দিন।
পরীক্ষার্থীদের কারও উচিত ছিল, প্রশ্নপত্রের মার্জিনে লিখে দেওয়া: তিনজন একসঙ্গে কাজটি করবে না। কারণ, দেশের নেতারা তিনজন তো দূরের কথা, দুজনও একসঙ্গে কাজ করা পছন্দ করেন না। সুতরাং রহিম, করিম ও গাজী একসঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই পারে না।
আরেকটি প্রশ্ন ছিল: বাংলাদেশ কোন সাল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছে? চারটি অপশন—(ক) ১৯৮২ (খ) ১৯৮৫ (গ) ১৯৭৫ (ঘ) ১৯৮৯। চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে ১৯৮৮ সাল। প্রশ্ন তৈরিকারী বলবেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কবে গেল সেটা বড় কথা নয়, ডলার কত এল সেটাই আসল। প্রশ্নপত্রে, ডলারের কথা নেই কেন?
এর আগে ৩০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও ভুল ও অসংগতি ছিল। এবারের ভুলের ব্যাপারে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভুলের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তবে পরীক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না।’
কর্মকর্তা বিব্রত বা লজ্জিত হননি। সোজা বলে দিয়েছেন, সমস্যা হবে না। এ দেশে কোনো অপরাধ, অপকর্ম ও ভুলেই যেকোনো সমস্যা হয় না, তা কে না জানে। সমস্যা না হলে ভুল করতে দোষ কী? খুব বড় ভুল যদি হয়, তা হলে ভুলকরনেওয়ালা মাথা চাপড়ে বলবেন: জোট সরকারের সময় আমারে যে-বিপদে ফেইলা দিছিল যে বাঁচারই কথা না। তাড়াতাড়ি নির্বাচনটা না দিলে এক্কেবারে গেছিলাম। তা ছাড়া ঊনত্রিশে ডিসেম্বর জীবন বাজি রাইখা—।
পিএসসির পরীক্ষার দায়িত্বরত একজন সদস্য ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করে থাকেন না—এ জন্য এমনটা হতেও পারে। পরীক্ষার্থীদের অযথা উদ্বিগ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করেন না, চেয়ারম্যান করেন না, সচিব করেন না, মন্ত্রী করেন না—তা সবাই জানে। তবে কেউ না কেউ তো করেন। যিনি করেছেন, এখন আর তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
পরীক্ষা গ্রহণেও ছিল নানা রকম অনাচার। পরীক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। ৫৯৬ পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে বিভ্রান্তি। একাধিক পরীক্ষার্থীর একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর। সিট খুঁজতে ও পরীক্ষাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষার্থীদের কিছু সুবিধার ব্যবস্থাও করে দেন পিএসসির কর্মকর্তারা। ‘পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।’ মানা হয়নি কারণ, পরীক্ষা দিচ্ছেন কোন প্রজন্ম ও সংগঠনের সদস্যরা, তা তো বিবেচনা করতে হবে এবং মাথায়-হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ফেরার সাধ এই বীরের দেশেও খুব কম মানুষেরই রয়েছে।
সমাজে ও রাষ্ট্রে সবকিছু চক্রাকারে হয়। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। নৈতিকতা ও শিক্ষার মান উঁচু হলে সুশিক্ষিত মানুষ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাছাই করে সবচেয়ে সেরাদের প্রশাসনে নিয়োগ দিলে ভালো ও দক্ষ প্রশাসন পাওয়া যায়। নিম্নমানের শিক্ষা, কারসাজি করে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে, মেধাবীরা সুযোগ না পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসন ধ্বংস হয়ে যায়। তা যে যায়, তার প্রমাণ গত ৪০ বছরের বাংলাদেশ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

8:35 AM Share:
‘সংবর্ধনা’ শব্দটির অর্থ বাংলা একাডেমী অভিধানে দেখতে পাচ্ছি: ১ অতি বৃদ্ধি; বাড়ানো। ২ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা, সম্মাননা। সংবর্ধনা কথাটার মধ্যেই বাড়াবাড়ি আছে। কাউকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হবে, ধরেই নেওয়া যায়, অতীব বাড়াবাড়ি করা হবে। তিলকে তাল করা হবে তো বটেই, পারলে তিলকে চালকুমড়া করা হবে। বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ফিরছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি নাকি এক বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। কী সেটা? একটা রাজ্য, নিউ জার্সির সিনেটের সভায় তিনি যোগ দেন এবং সেই সিনেটের অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন ও সন্ত্রাস দমনে খালেদা জিয়ার অবদান’-এর জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিংবা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের সাক্ষাৎ না ঘটায় নেতা-কর্মীদের হতাশার পটে আমেরিকার একটা ‘রাজ্যের’ সিনেট সভায় যোগ দেওয়াটা নিশ্চয়ই খুবই সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু সেটা কি এত বড় সম্মানের যে তাঁকে ‘বিশাল সম্মাননা’ দিতে হবে? আমরা সবাই জানি, নেতা-নেত্রীরা বিদেশ থেকে ফিরে এলে বিমানবন্দরে জনতার ভিড় লাগিয়ে দেওয়া আমাদের একটা চিরাচরিত রাজনৈতিক কর্মসূচি, এটা একেবারেই ‘রুটিন কর্মসূচি’। কাজেই নেতা বা নেত্রী বিদেশে কী কী অর্জন করেছেন, সেটা মোটেও বিবেচ্য নয়; কত বেশিসংখ্যক মানুষকে জড়ো করা গেল বিমানবন্দরে ও সড়কে, সেইটাই বড় কথা। এসবের মাধ্যমে দলের শক্তি প্রদর্শিত হয়, নেতা বা নেত্রী কত জনপ্রিয়, সেটা দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই শক্তির আঁচ প্রতিপক্ষকে টের পাইয়ে দেওয়া যায়। এ ধরনের সংবর্ধনা কেবল খালেদা জিয়া একাই লাভ করেন তা নয়, অন্য নেতা-নেত্রীরাও অতীতে লাভ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ফরাসি দেশ থেকে যে একটা নতুন ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন, সে উপলক্ষে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা হতে না দেওয়ার মতো বিরল ঘটনা কেন ঘটল, আমরা জানি না। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজেই বারণ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার জন্য এটা হয়তো একটা ছোট্ট ত্যাগ স্বীকার, কিন্তু নগরবাসী আমজনতার জন্য এটা যে একটা বড় স্বস্তি, তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সর্বশেষ সংবর্ধনার দিনটিকে যানজটে নাকাল ভুক্তভোগীরা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখবেন। শেখ হাসিনা এবার সংবর্ধনা না নেওয়ার জন্য আমাদের কাছ থেকে একটা বিশাল ধন্যবাদ পেতে পারেন।
২৯ মে ২০১১ সালে বেগম জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনার ফলটা কী রকম ফলল? অন্য কোনো পত্রিকা নয়, আমার দেশ পত্রিকা লিখেছে, ‘পায়ে হাঁটার গতিতে গাড়ি ছুটে চলে গুলশানের দিকে। বিমানবন্দর থেকে জিয়া কলোনি-সংলগ্ন রেললাইন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আসতেই সময় লাগে দুই ঘণ্টা। পাঁচটা ৪২ মিনিটের দিকে বিমানবন্দর থেকে গাড়ি চলতে শুরু করলেও সড়কের দুই পাশে দাঁড়ানো নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে দিতে সামনে এগিয়ে চলে তাঁর গাড়িবহর। খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, র্যাডিসন, জিয়া কলোনি হয়ে বেগম জিয়ার বাসভবনে পৌঁছে রাত পৌনে আটটার দিকে। এতে পুরো রাজধানী কয়েক ঘণ্টার যানজটে পড়ে যায়। কর্মস্থল-ফেরত হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। রাত ১১টা পর্যন্ত ব্যাপক যানজট ছিল ঢাকা শহরে।’ (দৈনিক আমার দেশ, ৩০ মে, ২০১১)
এই কৌতুকটি আপনাদের জানা। রাজা বেরিয়েছেন প্রাতর্ভ্রমণে। পথে দেখা এক কৃষকের সঙ্গে। ফেরার পর রাজার প্রাতরাশে পড়ল একটা মাছি। রাজা বললেন, সকালে কার মুখ দেখেছি যে আজ আমার এই দুর্ভোগ? কে সেই অপয়া? ধরে আনা হলো সেই কৃষককে। তার মুখ দেখেছিলেন বলেই রাজার পাতে মাছি পড়েছে। গোপাল ভাঁড় দেখা করলেন কৃষকের সঙ্গে, তাকে শিখিয়ে দিলেন উকিলি বুদ্ধি। কৃষক বলল, মহারাজ, আমি বড় অপয়া। সকালবেলা আমার মুখ দেখেছিলেন বলে আপনার পাতে মাছি পড়েছে। আর আজ সকালে আমি দেখেছিলাম আপনার মুখ। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখন ভেবে দেখুন, কে বেশি অপয়া?
গত পরশু যাঁরা বিমানবন্দর সড়কটি ব্যবহার করতে গিয়ে বেগম জিয়ার সংবর্ধনাজনিত ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন, এই ক্ষুদ্র নাগরিক তাঁদেরই একজন। উত্তরায় একটা স্কুলে আয়োজিত এক বইমেলা থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। কিন্তু ওই স্কুলের গেট থেকেই বেরোনো যাচ্ছিল না। তাকিয়ে দেখি, বিমানবন্দরগামী সড়কটিতে যানবাহন স্থির হয়ে আছে দুষ্ট জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় পাথরে পরিণত হওয়া নগরের মতো। ঘণ্টা আধেক ঠায় গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আমাদের হুঁশ হয় যে এই সময় বেগম জিয়া বেরোতে পারেন বিমানবন্দর থেকে, কাজেই অনড়-অচল গাড়িতে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আমরা একটা খাবারঘরে আশ্রয় নিই। পৌনে আটটার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে উত্তরার ভেতরের পথ-উপপথ বেয়ে বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণমুখী লেনে উঠে পড়তে সক্ষম হই। এর পরে যা দেখি, তা ভাষায় প্রকাশ করাই অসম্ভব। আমরা বাঁয়ের লেন ধরে ঢাকার দিকে যাব বলে যানজটে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু বহুসংখ্যক গাড়ি ডান পাশের লেন ধরে উল্টো দিক দিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে গোদের ওপর বিষফোড়া সৃষ্টি করেছে। কারণ তাদের বিপরীত দিক থেকে উত্তরমুখী যানবাহন আসছে। একই লেনে ঢাকামুখী ও ঢাকাত্যাগী যানবাহনগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় ‘বোতলবন্দী’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ডান পাশের লেনে কোনো কিছুই নড়ছে না। আমাদের লেনটা তবু নড়ছে। আমরা সঠিক লেনে থাকায় শম্বুকগতিতে হলেও চলতে পারছি। যাঁরা ‘রং সাইড’ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছেন, তাঁরা কেবল নিজেরা আটকা পড়েছেন তা-ই নয়, বিপরীত দিক থেকে ‘রাইট সাইড’ দিয়ে আসা যানবাহনগুলোকেও যেন চিরতরে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সততাই যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, তা পুনর্বার উপলব্ধি করতে পারলাম। নিজেরা তো ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু কী হবে তাঁদের, যাঁরা বেরিয়েছিলেন বিমানবন্দরে বিমান ধরবেন বলে? দেখলাম, বাসযাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে বাস থেকে নেমে পড়ছে, এদের মধ্যে নারী-শিশুও আছে। এরা কী করে বিমানবন্দর সড়কের বুক পরিমাণ উঁচু সড়ক বিভাজকটা পার হবে, কে জানে! কয়েকজনকে দেখলাম বড় বড় সুটকেস হাতে করে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে বিদেশিও আছেন। যানজটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সও আটকা পড়ে কাতর স্বরে কাঁদছে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আমরা সাড়ে নয়টার দিকে ধানমন্ডিতে পৌঁছাতে পেরেছি, কিন্তু আমার দেশ পত্রিকাই লিখেছে, রাত ১১টা পর্যন্ত এই যানজট ছিল।
রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, নীতির রাজা। রাজপথ মানেও রাজার পথ নয়, পথের রাজা। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ ঘটে, এমন কর্মসূচি কি না দিলেই নয়? সংবর্ধনা তো একটা বিলাসী কর্মসূচি, তাতে কার কী লাভ হয়? এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক টাকা-পয়সা জোগাড় করতে হয়, আর খরচও করতে হয়, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। মানুষের শ্রমঘণ্টা অপচয়িত হয়, রাস্তায় জ্বালানি পোড়ে, বাতাস আরেকটু দূষিত হয়; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। যে রোগী আটকা পড়েছেন অ্যাম্বুলেন্সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে যাঁর পথে, তাঁর কথা আর তাঁর স্বজনদের কথা একবার ভাবার সময় কি জনসেবকদের হবে? হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ—এ ধরনের কর্মসূচিমাত্রই ভোগান্তিকর। সরকারের অন্যায়, ভুলত্রুটির নিশ্চয়ই সমালোচনা করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিরোধও করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা মানুষকে না ভুগিয়ে করার কথা কেউ কি ভাববেন? সবচেয়ে ভালো হলো জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়া। সংসদে গিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা। ওয়াকআউট করা। তাতে আমরা রাস্তাঘাটে একটু নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারি। এমনিতেই কোনো উপলক্ষ ছাড়াই যানজটে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ। তার ওপর যদি নেতা-নেত্রীরা বিদেশে কোনো রাজ্যের সিনেট সভায় যোগ দেওয়াকে উদ্যাপনযোগ্য সাফল্য বলে ভাবতে থাকেন, তাহলে আমরা যাই কই? বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, মানুষ হরতাল-অবরোধের জন্য বিরোধী দলকে পরবর্তী নির্বাচনের সময় ভোট দেননি; ভোট দিয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা, সরকারি দলের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ হিসেবে। নব্বইয়ের পরে চারবার তা-ই ঘটেছে। চুপচাপ বসে থাকলেও ভোট পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে জনতা এই সংবর্ধনাজাতীয় কর্মসূচিতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন, তাঁদের ভোটেই ক্ষমতার বদল ঘটে। নেতা-কর্মীরা তো বাঁধা ভোটার। তাঁদের ভোট দুই বড় দল সব সময়ই লাভ করে। নীরব ভোটার, যাঁরা একবার এ-পক্ষে, আরেকবার ও-পক্ষে যান, তাঁরাই নির্ধারণ করেন ক্ষমতায় কে বসবে। এবং এই প্রসঙ্গে এ কথাও বলাটা জরুরি যে বিদেশিরা এই দেশের ক্ষমতার নিয়ামক নয়। তাদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে ধরনা যে কেবল এইবারের বিরোধী দল প্রথম দিচ্ছে, তা নয়, এই ধরনা সব পক্ষই অতীতে বহুবার দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তো দিয়েছেই। ক্ষমতার বাইরে থাকা একজন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের কাছে বা বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম গাওয়াকে কখনোই পছন্দ করে না, সেটা আওয়ামী লীগ করলেও না, বিএনপি করলেও না। দেশের ভোটারদের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, তাঁরা এই সম্মানটুকুকে খুবই মূল্যবান মনে করেন যে আমার ভোটে ক্ষমতা নির্ধারিত হয়, বিদেশিদের অঙ্গুলি হেলনে নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক

বিরল অর্জন, বিশাল সংবর্ধনা, বিকট জট

Posted by Unknown  |  No comments

‘সংবর্ধনা’ শব্দটির অর্থ বাংলা একাডেমী অভিধানে দেখতে পাচ্ছি: ১ অতি বৃদ্ধি; বাড়ানো। ২ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা, সম্মাননা। সংবর্ধনা কথাটার মধ্যেই বাড়াবাড়ি আছে। কাউকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হবে, ধরেই নেওয়া যায়, অতীব বাড়াবাড়ি করা হবে। তিলকে তাল করা হবে তো বটেই, পারলে তিলকে চালকুমড়া করা হবে। বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ফিরছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি নাকি এক বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। কী সেটা? একটা রাজ্য, নিউ জার্সির সিনেটের সভায় তিনি যোগ দেন এবং সেই সিনেটের অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন ও সন্ত্রাস দমনে খালেদা জিয়ার অবদান’-এর জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিংবা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের সাক্ষাৎ না ঘটায় নেতা-কর্মীদের হতাশার পটে আমেরিকার একটা ‘রাজ্যের’ সিনেট সভায় যোগ দেওয়াটা নিশ্চয়ই খুবই সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু সেটা কি এত বড় সম্মানের যে তাঁকে ‘বিশাল সম্মাননা’ দিতে হবে? আমরা সবাই জানি, নেতা-নেত্রীরা বিদেশ থেকে ফিরে এলে বিমানবন্দরে জনতার ভিড় লাগিয়ে দেওয়া আমাদের একটা চিরাচরিত রাজনৈতিক কর্মসূচি, এটা একেবারেই ‘রুটিন কর্মসূচি’। কাজেই নেতা বা নেত্রী বিদেশে কী কী অর্জন করেছেন, সেটা মোটেও বিবেচ্য নয়; কত বেশিসংখ্যক মানুষকে জড়ো করা গেল বিমানবন্দরে ও সড়কে, সেইটাই বড় কথা। এসবের মাধ্যমে দলের শক্তি প্রদর্শিত হয়, নেতা বা নেত্রী কত জনপ্রিয়, সেটা দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই শক্তির আঁচ প্রতিপক্ষকে টের পাইয়ে দেওয়া যায়। এ ধরনের সংবর্ধনা কেবল খালেদা জিয়া একাই লাভ করেন তা নয়, অন্য নেতা-নেত্রীরাও অতীতে লাভ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ফরাসি দেশ থেকে যে একটা নতুন ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন, সে উপলক্ষে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা হতে না দেওয়ার মতো বিরল ঘটনা কেন ঘটল, আমরা জানি না। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজেই বারণ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার জন্য এটা হয়তো একটা ছোট্ট ত্যাগ স্বীকার, কিন্তু নগরবাসী আমজনতার জন্য এটা যে একটা বড় স্বস্তি, তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সর্বশেষ সংবর্ধনার দিনটিকে যানজটে নাকাল ভুক্তভোগীরা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখবেন। শেখ হাসিনা এবার সংবর্ধনা না নেওয়ার জন্য আমাদের কাছ থেকে একটা বিশাল ধন্যবাদ পেতে পারেন।
২৯ মে ২০১১ সালে বেগম জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনার ফলটা কী রকম ফলল? অন্য কোনো পত্রিকা নয়, আমার দেশ পত্রিকা লিখেছে, ‘পায়ে হাঁটার গতিতে গাড়ি ছুটে চলে গুলশানের দিকে। বিমানবন্দর থেকে জিয়া কলোনি-সংলগ্ন রেললাইন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আসতেই সময় লাগে দুই ঘণ্টা। পাঁচটা ৪২ মিনিটের দিকে বিমানবন্দর থেকে গাড়ি চলতে শুরু করলেও সড়কের দুই পাশে দাঁড়ানো নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে দিতে সামনে এগিয়ে চলে তাঁর গাড়িবহর। খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, র্যাডিসন, জিয়া কলোনি হয়ে বেগম জিয়ার বাসভবনে পৌঁছে রাত পৌনে আটটার দিকে। এতে পুরো রাজধানী কয়েক ঘণ্টার যানজটে পড়ে যায়। কর্মস্থল-ফেরত হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। রাত ১১টা পর্যন্ত ব্যাপক যানজট ছিল ঢাকা শহরে।’ (দৈনিক আমার দেশ, ৩০ মে, ২০১১)
এই কৌতুকটি আপনাদের জানা। রাজা বেরিয়েছেন প্রাতর্ভ্রমণে। পথে দেখা এক কৃষকের সঙ্গে। ফেরার পর রাজার প্রাতরাশে পড়ল একটা মাছি। রাজা বললেন, সকালে কার মুখ দেখেছি যে আজ আমার এই দুর্ভোগ? কে সেই অপয়া? ধরে আনা হলো সেই কৃষককে। তার মুখ দেখেছিলেন বলেই রাজার পাতে মাছি পড়েছে। গোপাল ভাঁড় দেখা করলেন কৃষকের সঙ্গে, তাকে শিখিয়ে দিলেন উকিলি বুদ্ধি। কৃষক বলল, মহারাজ, আমি বড় অপয়া। সকালবেলা আমার মুখ দেখেছিলেন বলে আপনার পাতে মাছি পড়েছে। আর আজ সকালে আমি দেখেছিলাম আপনার মুখ। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখন ভেবে দেখুন, কে বেশি অপয়া?
গত পরশু যাঁরা বিমানবন্দর সড়কটি ব্যবহার করতে গিয়ে বেগম জিয়ার সংবর্ধনাজনিত ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন, এই ক্ষুদ্র নাগরিক তাঁদেরই একজন। উত্তরায় একটা স্কুলে আয়োজিত এক বইমেলা থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। কিন্তু ওই স্কুলের গেট থেকেই বেরোনো যাচ্ছিল না। তাকিয়ে দেখি, বিমানবন্দরগামী সড়কটিতে যানবাহন স্থির হয়ে আছে দুষ্ট জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় পাথরে পরিণত হওয়া নগরের মতো। ঘণ্টা আধেক ঠায় গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আমাদের হুঁশ হয় যে এই সময় বেগম জিয়া বেরোতে পারেন বিমানবন্দর থেকে, কাজেই অনড়-অচল গাড়িতে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আমরা একটা খাবারঘরে আশ্রয় নিই। পৌনে আটটার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে উত্তরার ভেতরের পথ-উপপথ বেয়ে বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণমুখী লেনে উঠে পড়তে সক্ষম হই। এর পরে যা দেখি, তা ভাষায় প্রকাশ করাই অসম্ভব। আমরা বাঁয়ের লেন ধরে ঢাকার দিকে যাব বলে যানজটে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু বহুসংখ্যক গাড়ি ডান পাশের লেন ধরে উল্টো দিক দিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে গোদের ওপর বিষফোড়া সৃষ্টি করেছে। কারণ তাদের বিপরীত দিক থেকে উত্তরমুখী যানবাহন আসছে। একই লেনে ঢাকামুখী ও ঢাকাত্যাগী যানবাহনগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় ‘বোতলবন্দী’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ডান পাশের লেনে কোনো কিছুই নড়ছে না। আমাদের লেনটা তবু নড়ছে। আমরা সঠিক লেনে থাকায় শম্বুকগতিতে হলেও চলতে পারছি। যাঁরা ‘রং সাইড’ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছেন, তাঁরা কেবল নিজেরা আটকা পড়েছেন তা-ই নয়, বিপরীত দিক থেকে ‘রাইট সাইড’ দিয়ে আসা যানবাহনগুলোকেও যেন চিরতরে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সততাই যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, তা পুনর্বার উপলব্ধি করতে পারলাম। নিজেরা তো ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু কী হবে তাঁদের, যাঁরা বেরিয়েছিলেন বিমানবন্দরে বিমান ধরবেন বলে? দেখলাম, বাসযাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে বাস থেকে নেমে পড়ছে, এদের মধ্যে নারী-শিশুও আছে। এরা কী করে বিমানবন্দর সড়কের বুক পরিমাণ উঁচু সড়ক বিভাজকটা পার হবে, কে জানে! কয়েকজনকে দেখলাম বড় বড় সুটকেস হাতে করে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে বিদেশিও আছেন। যানজটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সও আটকা পড়ে কাতর স্বরে কাঁদছে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আমরা সাড়ে নয়টার দিকে ধানমন্ডিতে পৌঁছাতে পেরেছি, কিন্তু আমার দেশ পত্রিকাই লিখেছে, রাত ১১টা পর্যন্ত এই যানজট ছিল।
রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, নীতির রাজা। রাজপথ মানেও রাজার পথ নয়, পথের রাজা। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ ঘটে, এমন কর্মসূচি কি না দিলেই নয়? সংবর্ধনা তো একটা বিলাসী কর্মসূচি, তাতে কার কী লাভ হয়? এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক টাকা-পয়সা জোগাড় করতে হয়, আর খরচও করতে হয়, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। মানুষের শ্রমঘণ্টা অপচয়িত হয়, রাস্তায় জ্বালানি পোড়ে, বাতাস আরেকটু দূষিত হয়; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। যে রোগী আটকা পড়েছেন অ্যাম্বুলেন্সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে যাঁর পথে, তাঁর কথা আর তাঁর স্বজনদের কথা একবার ভাবার সময় কি জনসেবকদের হবে? হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ—এ ধরনের কর্মসূচিমাত্রই ভোগান্তিকর। সরকারের অন্যায়, ভুলত্রুটির নিশ্চয়ই সমালোচনা করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিরোধও করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা মানুষকে না ভুগিয়ে করার কথা কেউ কি ভাববেন? সবচেয়ে ভালো হলো জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়া। সংসদে গিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা। ওয়াকআউট করা। তাতে আমরা রাস্তাঘাটে একটু নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারি। এমনিতেই কোনো উপলক্ষ ছাড়াই যানজটে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ। তার ওপর যদি নেতা-নেত্রীরা বিদেশে কোনো রাজ্যের সিনেট সভায় যোগ দেওয়াকে উদ্যাপনযোগ্য সাফল্য বলে ভাবতে থাকেন, তাহলে আমরা যাই কই? বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, মানুষ হরতাল-অবরোধের জন্য বিরোধী দলকে পরবর্তী নির্বাচনের সময় ভোট দেননি; ভোট দিয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা, সরকারি দলের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ হিসেবে। নব্বইয়ের পরে চারবার তা-ই ঘটেছে। চুপচাপ বসে থাকলেও ভোট পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে জনতা এই সংবর্ধনাজাতীয় কর্মসূচিতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন, তাঁদের ভোটেই ক্ষমতার বদল ঘটে। নেতা-কর্মীরা তো বাঁধা ভোটার। তাঁদের ভোট দুই বড় দল সব সময়ই লাভ করে। নীরব ভোটার, যাঁরা একবার এ-পক্ষে, আরেকবার ও-পক্ষে যান, তাঁরাই নির্ধারণ করেন ক্ষমতায় কে বসবে। এবং এই প্রসঙ্গে এ কথাও বলাটা জরুরি যে বিদেশিরা এই দেশের ক্ষমতার নিয়ামক নয়। তাদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে ধরনা যে কেবল এইবারের বিরোধী দল প্রথম দিচ্ছে, তা নয়, এই ধরনা সব পক্ষই অতীতে বহুবার দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তো দিয়েছেই। ক্ষমতার বাইরে থাকা একজন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের কাছে বা বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম গাওয়াকে কখনোই পছন্দ করে না, সেটা আওয়ামী লীগ করলেও না, বিএনপি করলেও না। দেশের ভোটারদের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, তাঁরা এই সম্মানটুকুকে খুবই মূল্যবান মনে করেন যে আমার ভোটে ক্ষমতা নির্ধারিত হয়, বিদেশিদের অঙ্গুলি হেলনে নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

8:31 AM Share:
Get updates in your email box
Complete the form below, and we'll send you the best coupons.

Deliver via FeedBurner
Proudly Powered by Blogger.
back to top